আবদুল্লাহ আল হৃদয়ঃ-
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার বুধন্তী, চান্দুরা ও হরষপুর ইউনিয়নকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) সংসদীয় আসনের সঙ্গে সংযুক্ত করার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) খসড়া প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনা এখন চরমে। ‘অখণ্ড বিজয়নগর’ এর দাবিতে চলমান আন্দোলনের মধ্যেই গতকাল ২৪শে আগস্ট, ২০২৫ তারিখে নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠিত শুনানিতে হট্টগোল ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। এর জের ধরে সরাইল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী পালন করেছে বিবাদমান পক্ষগুলো, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণের খসড়া প্রকাশ করলে এই সংকটের সূত্রপাত হয়। খসড়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসন থেকে বিজয়নগরের ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ইউনিয়ন বুধন্তী, চান্দুরা ও হরষপুরকে কেটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়।
এই প্রস্তাব প্রকাশের পর থেকেই বিজয়নগরের সর্বস্তরের জনগণ তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করে। তাদের মূল দাবি, কোনোভাবেই বিজয়নগর উপজেলাকে বিভক্ত করা যাবে না। আন্দোলনকারীরা মনে করছেন, এই বিভক্তির ফলে ইউনিয়নগুলোর জনগণ বারবার বৈষম্য ও অবহেলার শিকার হবেন। ‘অখণ্ড বিজয়নগর চাই’ স্লোগানে ‘বিজয়নগর সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদে’র ব্যানারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে এই বিভক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচী পালন করে আসছে তারা। আন্দোলনকারীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, দাবি আদায় না হলে ভবিষ্যতে রেলপথ ও সড়কপথ অবরোধের মতো আরও কঠোর কর্মসূচীতে যাবেন তারা।
গতকাল রোববার (২৪ আগস্ট) ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে এ বিষয়ে এক শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তবে শুনানি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রস্তাবের পক্ষে ও বিপক্ষের দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র বাগবিতণ্ডা শুরু হয়, যা এক পর্যায়ে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি ও কিল-ঘুষিতে রূপ নেয়।
শুনানিতে খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। অন্যদিকে, প্রস্তাবের বিরোধিতা করে অখণ্ড বিজয়নগরের পক্ষে নিজেদের জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মোঃ আতাউল্লাহসহ বিজয়নগরের আন্দোলনকারীরা। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে দুই পক্ষের সমর্থকরা সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন, যা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সামনেই ঘটে। এই ঘটনায় বিএনপির নেত্রী রুমিন ফারহানা তার নিজ দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। অপরদিকে এনসিপির পক্ষ থেকেও তাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ আনা হয়।
নির্বাচন কমিশনের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার রেশ রাজপথ পর্যন্ত গড়িয়েছে। শুনানিতে হট্টগোলের প্রতিবাদে এবং ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার ওপর হামলার অভিযোগে তার সমর্থকরা গতকাল সন্ধ্যায় সরাইলের শাহবাজপুর এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে। তারা টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে এবং রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়, যার ফলে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। হামলাকারীদের গ্রেফতারের দাবি জানান তারা, অন্যথায় কঠোর কর্মসূচির হুশিয়ারি দেন।
অন্যদিকে, একই দিনে নির্বাচন কমিশনে মোঃ আতাউল্লাহর ওপর হামলার প্রতিবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করেন, রুমিন ফারহানা ও তার সমর্থকরা গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার বর্হিভূত আচরণ করেছেন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছেন।
এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজ নিজ অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। বিজয়নগর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইমাম হোসেন ও এডভোকেট শরিফুল ইসলাম লিটন বলেন, আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। উপজেলা হেফাজতে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আফজাল হোসেনও এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেত্রী নাদিয়া পাঠান পাপন, যিনি বিজয়নগরের চান্দুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা, এই বিভক্তিকে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের ‘নোংরা খেলা’ বলে অভিহিত করে অখণ্ড বিজয়নগর রক্ষার জন্য যেকোনো কঠোর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন।
সব মিলিয়ে, বিজয়নগরের তিনটি ইউনিয়নের সংসদীয় আসন পরিবর্তনের এই প্রস্তাবটি স্থানীয় রাজনীতিতে এক উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই, তবে রাজপথের এই আন্দোলন ও পাল্টাপাল্টি অবস্থান সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।
Leave a Reply