
আবদুল্লাহ আল হৃদয়ঃ-
তিতাস নদীর তীরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা ইউনিয়নে অবস্থিত সাপুটিয়া বিল, যা একসময় মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস ছিল, আজ পরিণত হয়েছে এক বিশাল কর্মযজ্ঞে। বিলের জলের গভীরে চলছে নির্বিচারে মাছের হরিলুট, আর এর পেছনে জড়িয়ে আছে অধিকার, রাজস্ব এবং জীবিকার এক জটিল সমীকরণ।
গত বুধবার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাপুটিয়া বিলের চিত্র এক অন্যরকম গল্প বলছে। বিলের ভেতরে অসংখ্য নৌকা, আর প্রতিটি নৌকাতেই ব্যস্ত জেলেরা। তাদের হাতে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, যা দিয়ে নির্বিচারে ধরা হচ্ছে ছোট-বড় মাছ। এ যেন বিল জুড়ে এক নীরব প্রতিযোগিতা, যেখানে আইন ও অধিকারের বিষয়টি চাপা পড়ে যাচ্ছে।
সাপুটিয়া বিলের লিজগ্রহীতা বুধন্তি মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি নিখিল দাস যিনি ১৪২৯ থেকে ১৪৩৪ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত ছয় বছরের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে বিলটি লিজ নিয়েছেন, অভিযোগ করেন যে তিনি প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তার অভিযোগ, আশপাশের কয়েকটি গ্রামের কিছু অসাধু ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করে এবং অবৈধ জাল ব্যবহার করে মাছ ধরছে।
নিখিল দাস ও হামদু মিয়া বলেন, “সরকার প্রতি বছর আমাদের এই প্রকল্প থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা রাজস্ব পায়, যা আমি নিয়মিত পরিশোধ করি। এত ক্ষতির পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পাইনি।” তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে দ্রুত তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। তিনি আরও অভিযোগ করেন, “সাপুটিয়া, রামপুর ও বৈশামুড়া এলাকার কিছু মানুষ প্রায়ই কারেন্ট জাল নিয়ে বিলের বাঁধের ভিতরে প্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যায়। তাদেরকে কিছু বললে উল্টো ক্ষতি করার হুমকি দেয়।”
যারা বিলটিতে মাছ ধরতে এসেছেন, তাদের সাথে কথা বললে উঠে আসে এক ভিন্ন চিত্র। তাদের দাবি, “আমাদের পূর্বপুরুষেরা এখানে মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু বর্তমানে সরকার এ বিলটি লিজ দিয়েছে। আমরা বিলের পাড়ের অধিবাসী—আমাদেরও এখানকার মাছ ধরার অধিকার রয়েছে। নিজের খাবারের জন্যই একদিন মাছ ধরি।” তবে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এই মন্তব্যটি একটি পুরোনো অধিকারের স্মারক, যা আধুনিক লিজ পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক।
এ বিষয়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানান, “আমাদের কাছে এ বিষয়ে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি এবং আমরা এ ঘটনায় অবগত নই। অভিযোগ পেলে অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এই মন্তব্য প্রশাসনের এক ধরনের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে। যখন একটি বিল প্রকাশ্যে লুণ্ঠিত হচ্ছে, তখন লিখিত অভিযোগের অপেক্ষায় থাকা প্রশ্ন তোলে প্রশাসনের কার্যকারিতা নিয়ে।
সাপুটিয়া বিলের ঘটনাটি কেবল একটি বিলের মাছ চুরি নয়, এটি অধিকার, জীবিকা, এবং প্রশাসনের ভূমিকার এক বড় প্রশ্ন। লিজগ্রহীতার বিনিয়োগ, সরকারের রাজস্ব, এবং মৎস্যজীবীদের ঐতিহ্যগত অধিকার—এই তিনের মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রয়োজন। প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, কেবল লিখিত অভিযোগের অপেক্ষায় না থেকে। একই সাথে, স্থানীয় মৎস্যজীবীদের বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি করা এবং নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি।